
এমন নয় যে, কলাগাছের ছাল থেকে সুতা তৈরি হচ্ছে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ সুতা থেকে নানা ধরনের পণ্য তৈরি হচ্ছে, যা মানুষের কাছে বিপুল প্রশংসাও কুড়িয়েছে। তবে শাড়ি তৈরি একেবারেই নতুন। এটা আগে কোথাও হয়েছে বলে জানা নেই। সেদিক থেকে বান্দরবানে কলাগাছের তন্তু থেকে শাড়ি তৈরির উদ্যোগ বাংলাদেশে নতুন দিগন্তই উন্মোচন করেছে।
বান্দরবানে দেশে প্রথম বারের মতো তৈরি করা হয়েছে কলাগাছের সুতার শাড়ি। ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগ গ্রহণ করে দুই নারী চমক সৃষ্টি করেছেন। এই দুই নারীর চিন্তা ও কর্মতৎপরতার পেছনে জড়িয়ে আছে সফলতার গল্প। আর এই অসম্ভব কাজটি সম্ভব করেছেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন পারভীন তিবরীজি এবং মৌলভীবাজারের ৬৬ বছর বয়সী তাঁতশিল্পী রাধাবতী দেবী। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাঝেরগাঁও গ্রামের ভানুবিল এলাকার মণিপুরি কারিগর রাধাবতী দেবী। শাড়িটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘কলাবতী শাড়ি’। কলাগাছের ‘কলা’ এবং রাধাবতী নামের ‘বতী’ অংশ নিয়ে শাড়ির এমন নামকরণ করা হয়। রাধা দেবীকে স্মরণে রাখতে শাড়ির এ নাম দেওয়া হয়েছে। মাত্র ১৫ দিনের চেষ্টায় রাধাবতী দেবী ১ কেজি কলাগাছের সুতা দিয়ে তৈরি করেন এ শাড়ি। দৃষ্টিনন্দন এই শাড়ি দেখতে জামদানি শাড়ির মতোই।
বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে বহু আগে থেকেই কলার আঁশের ব্যবহার রয়েছে। জাপানিরা তাদের মুদ্রা ইয়েন তৈরিতে এই আঁশ ব্যবহার করে, নেপালের অধিবাসীরাও কলার আঁশ থেকে কম্বল তৈরি করে আসছে বহুদিন ধরেই। দড়ি, ব্যাগ, টেবিল ক্লথ, পর্দা এবং মাদুরও তৈরি করা হয় এটি থেকে। শুধুই কাপড় নয়, টিব্যাগ, ব্যাংকনোট, কাগজ, প্যাম্পারস, স্যানিটারি ন্যাপকিনও আজকাল তৈরি হচ্ছে কলার আঁশ থেকে।
বাংলাদেশেও বিভিন্ন প্রান্তে সরকারি ও বেসরকারি প্রকল্পের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগে কলার আঁশ সংগ্রহ, প্রস্ততকরণ ও বাজারজাত হচ্ছে। খাগড়াছড়িতে একটি বেসরকারি সংস্থা বেশ কয়েক বছর আগে কলার আঁশ থেকে উন্নতমানের সুতা তৈরির প্রকল্প শুরু করেছে। কলাগাছ আর আনারসের পাতা থেকে সুতা তৈরি করা হয়েছে টাঙ্গাইলের মধুপুরে, এটিও তত্ত্বাবধান করেছে বেসরকারি একটি সংস্থা। লালমনিরহাট, জয়পুরহাট, মিঠাপুকুর, যশোর, টাঙ্গাইল, খাগড়াছড়ি, ঠাকুরগাঁও সদরসহ দেশের সাত স্থানে কলাগাছ থেকে সুতা উৎপাদন প্রকল্প চলছে বলে জানিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধিরা। মানিকগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে মেশিন ব্যবহার করে সুতা উৎপাদন করছেন কয়েক জন। যেহেতু দেশে ব্যাপক পরিমাণ কলাগাছ প্রাকৃতিকভাবেই জন্মায় এবং এর চাষাবাদও সহজ ও লাভজনক। তাই কলার আঁশ প্রক্রিয়াজাত করে তা থেকে উন্নতমানের কাপড় ও অন্যান্য পোশাক সামগ্রী তৈরি করে টেক্সটাইল সেক্টরে উৎপাদন ও রপ্তানিকে আরও এক ধাপ বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
কলাবতী শাড়ির জন্ম :: এতদিন কলাগাছের তন্তু থেকে সুতা বানানো হতো আর এবার সেই সুতা দিয়ে বানানো হলো ১৩ হাত শাড়ি। পরিত্যক্ত কলাগাছের খোলস বের করে মেশিনে দেওয়া হয়। মেশিন থেকে বের হয়ে আসে আঁশযুক্ত সুতা। সেই সুতা ধুয়ে রোদে শুকানোর পর সুতার রং হয় সোনালি। সেই সুতা থেকে স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যাগ, ঝুড়ি, ফুলদানি, কলমদানি, ফাইল ফোল্ডার, নানান শোপিস, শতরঞ্জি, জুতা, টেবিল ম্যাটসহ বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্প বানানো হয়। এর সূত্র ধরেই পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে তাঁতে কাপড় বোনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আর এতেই আসে অভাবনীয় সাফল্য।
তাঁতশিল্পী রাধাবতী দেবী বলেন, ‘কলাগাছের সুতা দিয়ে যে শাড়ি হতে পারে, তা কখনো ভাবিনি। মৌলভীবাজার থেকে আসার সময় মণিপুরি শাড়ি বানানোর তাঁতযন্ত্র সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম। সেটি দিয়েই শাড়ি তৈরি করা হয়। এমনিতে শাড়ি তৈরিতে ৫০০ গ্রাম সুতা প্রয়োজন হয়। কিন্তু কলাগাছের সুতা থেকে শাড়ি তৈরিতে এক কেজি সুতা লেগেছিল। একটি কলাগাছ থেকে ২০০ গ্রাম সুতা পাওয়া যায়। সেই হিসাবে পাঁচটি কলাগাছ থেকে এক কেজি সুতা হয়।’ রাধাবতী দেবী বলেন, ‘আমি মণিপুরি শাড়ি তৈরি করছি ৩০ বছর ধরে। বাংলাদেশের কোথাও কলাগাছের আঁশ থেকে সুতা বের করে শাড়ি তৈরি হয়নি। ভারতের কোথাও কোথাও হয় বলেও শুনিনি। সে দিক থেকে বলা যায়, এটিই দেশে প্রথম কলাগাছের সুতার তৈরি শাড়ি।’ তিনি বলেন, ‘সুতাকে কীভাবে আরও নমনীয় করা যায় এবং কীভাবে আরও বেশি সুতা উৎপন্ন করা যায়, এসব বিষয়ে এখন ব্যাপক গবেষণা হওয়া দরকার।’
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বলেন, ‘পাহাড়ের নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির জন্য ২০২১ সালে বান্দরবানের বিভিন্ন পাড়ায় কলাগাছ থেকে সুতা তৈরির পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ইতিমধ্যে পাঁচ শতাধিক নারীকে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।’ তিনি জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে কলা চাষ হয়। ফল দেওয়ার পরে কলাগাছগুলো আর কাজে লাগে না। এ গাছগুলোকেই এখন কাজে লাগানো হচ্ছে। প্রথমে কলাগাছের আঁশ দিয়ে কাপড় বা শাড়ি বানানো যায় কি না, তা দেখার জন্যই কাপড় বানানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। কাপড় যেহেতু বানানো গেছে, তাই চেষ্টা করলে শাড়িও বানানো যাবে। এ চিন্তা থেকেই অগ্রসর এবং চিন্তার সফল বাস্তবায়ন।’ ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে বান্দরবান সদর উপজেলার ২ নম্বর কুহালং ইউনিয়নের আমতলীপাড়ায় কলাগাছের বাকল থেকে সুতা তৈরির পাইলট প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়। এই প্রকল্পে সহায়ক হিসেবে ছিল মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন, গ্রাউস ও উদ্দীপন। তখন থেকেই সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরকে সঙ্গে নিয়ে কলাগাছের তন্তু নিয়ে কাজ শুরু হয়। তার মতে, কলাগাছের সুতা থেকে শাড়ি তৈরি হওয়ায় তাঁতশিল্পে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়েছে। এ অসামান্য সফলতা ও সম্ভাবনাকে বাণিজ্যিক করতে গবেষণা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। এটিকে কাজে লাগাতে পারলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া বান্দরবান জেলায় কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। এ ব্যাপারে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়, তাঁত বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জায়গায় সহযোগিতা চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।’
জেলা প্রশাসক জানান, সুতাগুলো প্রক্রিয়াকরণ করতে সময় লেগেছে আট দিন। মূল শাড়ির কাপড় বুনতে সময় লেগেছে মাত্র সাত দিন। শাড়িতে কোনো রং ব্যবহার করা হয়নি। জামদানি নকশার জন্য লাল সবুজ সুতা ব্যবহার করা হয়েছে। শাড়ির পাড় বোনা হয়েছে কোরিয়ান সুতা দিয়ে আর শাড়ির জমিন ও আঁচল তৈরি করা হয়েছে কলাগাছের সুতা দিয়ে। একটি শাড়ি তৈরিতে খরচ পড়বে কারিগরের মজুরিসহ প্রায় চার হাজার টাকার মতো। যখন আরও কম সময়ে এই শাড়ি বানানো যাবে, তখন উৎপাদন খরচ অনেক কমে আসবে। ভবিষ্যতে পায়জামা, পাঞ্জাবি, শার্টসহ বিভিন্ন পরিধেয় বস্ত্র বানানোর পরিকল্পনা আছে। এছাড়াও কলাগাছের তন্তু দিয়ে ভবিষ্যতে নেকলেস, গলার মালা, কানের দুল, চুড়ি, হাতব্যাগ, শপিংব্যাগ, পুঁতির মালা, গলার মালাসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। আর এসব পণ্য তৈরিতে বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানও হবে বলে তিনি জানান ।
কলার বর্জ্যে কার্পেটসহ দৃষ্টিনন্দন পণ্য :: মধুপুর উপজেলার কাকড়াগুণির আনোয়ার হোসেন। তার বাড়ির কারখানায় কলাগাছের বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ে হচ্ছে সমৃদ্ধ আঁশ। এ আঁশ যাচ্ছে ক্ষুদ্র শিল্প ‘ক্ল্যাসিক্যাল হ্যান্ডমেইড প্রডাক্ট’-এর বগুড়া, রংপুর ও নীলফামারীর কারখানায়। সেখানেই তৈরি হচ্ছে কম্বল, কার্পেটসহ দৃষ্টিনন্দন সামগ্রী। আনোয়ার জানান, তার আঁশ কারখানায় ৫০ জন কাজ করেন। আঁশের প্রচুর চাহিদা। কাঁচামালের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। শুধু পুঁজির অভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি করা যাচ্ছে না।