জাকারিয়া ‘তিন চাকার’ মাফিয়া সিলেটের পরিবহন সেক্টরের ভেতর-বাহির পর্ব: ০২
সিলেট নগরীর জিন্দাবাজারে সিলেট জেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের একটি উপশাখা। শাখাটির অবস্থান জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যালয় সংলগ্ন গলির ভেতরে, তাই এর ছোট্ট পরিচয় মুক্তিযোদ্ধা উপশাখা হিসেবেই। সে উপশাখা অফিসে ফাই ফরমাশ খাটার চাকরি নিয়েছিলেন মো. জাকারিয়া আহমদ।
সে গল্পটি কয়েক দশক আগের। এখন সে জাকারিয়া আহমদই অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা-সভাপতি। নির্বাচন ছাড়াই দেড় যুগ ধরে অটোরিকশা শ্রমিকদের উপর ছড়ি ঘুরাচ্ছেন তিনি।
সিলেট বিভাগের শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে এ ইউনিয়নেই সবচেয়ে বেশি সদস্য। সদস্য সংখ্যা প্রায় ৪৫ হাজার। বিশাল এ শ্রমিকের শক্তিকে পুঁজি করে জাকারিয়া আহমদ যখন তখন সড়কে হামলে পড়েন। প্রতিষ্ঠা করেন ত্রাসের রাজত্ব। ‘ছোট যানে’র নেতা হলেও কাঁপন ধরিয়ে দেন ‘বড় যানে’র নেতাদের মনেও।
দাপটের রাজনীতিতে তিনি সমান তালে পাল্লা দেন ট্রাক-বাসের শ্রমিক নেতাদের সাথে। বাগিয়ে নিয়েছেন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদকের পদও। তার পেছনে অর্ধলক্ষ শ্রমিকের শক্তির পুঁজিই তাকে করে তুলেছে সিলেটের পরিবহন সেক্টরের ‘ঈশ্বর’। তার অঙ্গুলি হেলনে অচল হয়ে পড়ে সিলেটের রাজপথ। প্রশাসনও তার শক্তির কাছে খেই হারিয়ে ফেলে কখনও কখনও। বিধ্বংসী এই মাফিয়া এখন সিলেটের সাধারণ মানুষের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্ক।জাকারিয়া আহমদের বাড়ি সিলেট শহরতলির টুকেরবাজারে। বাবার নাম আবদুল হাসিব।
ছোটবেলাতেই বাবা তাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন। বাবার ত্যাজ্য সন্তান হিসেবে একদম খালি হাতে কর্মজীবন শুরু করা জাকারিয়া আহমদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধা উপশাখাই। কিছুদিন অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করায় শ্রমিকদের সাথে তারা চেনাজানা হতে থাকে। বুদ্ধির জোরে একসময় তাদেরই নেতা বনে যান। মুক্তিযোদ্ধা উপশাখার সভাপতিও হন এক সময়। তারপর থেকেই তার উত্থানের শুরু।
এক সময় দখলে আসে সিলেট জেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতির পদও। তারপর পেরিয়ে গেছে দেড় যুগ। পদ আগলে রেখেছেন এখনও। দীর্ঘ এ সময়ে দাপটের পাশাপাশি সম্পদও বাড়তে থাকে জাকারিয়া আহমদের। তবে কৌশলী জাকারিয়া আহমদ তার বিশাল সম্পদের খবর সাধারণ শ্রমিকের কাছে আড়াল করেই রাখেন।চোখে পড়ার ভয়ে দেশে তেমন সম্পদ না করলেও বিভিন্ন সূত্র বলছে, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার সম্পদ।
অটোরিকশা শ্রমিকদের স্বার্থ ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সিলেট জেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন। তবে অভিযোগ রয়েছে, ৭০৭ নম্বরে নিবন্ধিত এ ইউনিয়নটি এখন জাকারিয়া আহমদসহ অন্যান্য নেতাদের স্বার্থরক্ষার সংগঠনেই পরিণত হয়েছে। সড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশার রাজত্বে জাকারিয়া আহমদ যদি ‘রাজা’ হন তবে তার ‘সভাসদ’রা হলেন- ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আজাদ মিয়া, সহ সভাপতি সুন্দর আলী খান, আবুল খান, যুগ্ম সম্পাদক শাহাব উদ্দিন, সাংগঠনিক সম্পাদক ইকবাল আহমদ, অর্থ সম্পাদক মামুনুর রশীদ, প্রচার সম্পাদক আলতাফ আহমদ। ইউনিয়নের এ ৮ নেতার দাপটের কাছে সাধারণ শ্রমিকরা অসহায়।
প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদা দিলেও ইউনিয়ন থেকে কোনো সুবিধাই পান না তারা। অথচ নেতাদের ‘অ্যাকাউন্টে’ টাকা জমছে প্রতিদিনই। শ্রমিকের ঘামের টাকায় বাড়ি-গাড়ি করে এসির নীচে আয়েশি জীবন কাটছে তাদের। অবশ্য এ আট নেতার উপর অষ্টপ্রহর সাধারণ শ্রমিকের দীর্ঘশ্বাসের ছায়াও পড়ে।
লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা দিলেও নিজেদের বিপদে সাধারণ শ্রমিকরা কোনো সহযোগিতাই পান না নেতাদের কাছ থেকে। উল্টো ছোটখাট বিবাদ হলে সালিশ বৈঠকের জন্য নিজেদের পকেট খালি করে নেতাদের পকেট ভারি করতে হয়। নইলে ‘বিচার’ মেলে না। তারপরও সবকিছু মুখ বুজে মেনে নেন তারা। কারণ প্রতিবাদ করলে উল্টো মামলা-হয়রানির শিকার হতে হবে। অভিযোগ রয়েছে, পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে দিনের পর দিন ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণ কুক্ষিগত করে রেখেছে এ চক্রটি। নিরুপায় হয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে অটোরিকশা শ্রমিকরা সিলেটের শ্রম আদালতে একাধিক মামলাও করেছেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সিলেট কার্যালয় সূত্রের তথ্যমতে, সিলেট জেলায় নিবন্ধনকৃত সিএনজি অটোরিকশার সংখ্যা ১৯ হাজার ২৩২টি। এর বাইরে আরও অন্তত ২৫ হাজার নিবন্ধনহীন অটোরিকশা চলাচল করছে সিলেট জেলার পথে পথে। ২০১৪ সাল থেকে সিলেটে সিএনজি অটোরিকশার লাইসেন্স প্রদান বন্ধ থাকলেও প্রতিদিনই নতুন নতুন অটোরিকশা নামছে সড়কে। আম্বরখানা থেকে কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট। কুমারগাঁও তেমুখি থেকে শিবেরবাজার। টিলাগড় থেকে কানাইঘাট। দক্ষিণ সুরমা থেকে গোলাপগঞ্জ, বিশ্বনাথ, বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জসহ প্রতিটি রুটেই রেজিস্ট্রেশনবিহীন অসংখ্য অটোরিকশা চলছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ‘অনটেস্ট’ নামে পরিচিত নিবন্ধনহীন অটোরিকশাকে সড়কে চলাচলের জন্য একটি স্টিকার সরবরাহ করে অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন। এ স্টিকার থাকলে অটোরিকশাটিকে রাস্তায় পুলিশি ‘ঝামেলা’য় পড়তে হয় না। এ জন্য প্রতি অটোরিকশাকে মাসে ৭শ টাকা করে দিতে হয়। এ ছাড়া রাস্তায় বের হলে প্রতিদিন অটোরিকশা প্রতি ৩০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। আর ‘লাইনম্যানে’র হাতে গুঁজে দিতে হয় আরও ৫০ থেকে ৬০ টাকা। অর্থাৎ পথ চলতে একটি ‘অনটেস্ট’ অটোরিকশাকে মাসে ইউনিয়নের হাতে তুলে দিতে হয় কমপক্ষে ৩ হাজার টাকা। সে হিসেবে সড়কে চলতে থাকা ২৫ হাজার অনটেস্ট অটোরিকশা থেকে শ্রমিক ইউনিয়নের হাতে উঠে আসে মাসে সাড়ে সাত কোটি টাকা। শ্রমিক নেতারা আয়ের এ খাতটি নষ্ট হোক তা কিছুতেই চান না। মুখে নিবন্ধনহীন অটোরিকশার নিবন্ধনের দাবি করলেও, তারাই চান না অবৈধ অটোরিকশাগুলো বৈধ হোক। অবৈধ অটোরিকশাগুলো সড়কে চলাচলের বৈধতা পেলে আয়ের মূল পথটিই বন্ধ হয়ে যাবে।
রাজপথের খবর বলছে, অনটেস্ট গাড়ির ‘আয়’ লাইন হিসেবে ভাগাভাগি করে নেন কমিটির নেতারা। সুন্দর আলী খান নিয়ন্ত্রণ করেন তাজপুর-গোয়ালাবাজার লাইন। এ রুটে চলাচলকারী ২ হাজার অটোরিকশা থেকে ইউনিয়নের নামে উঠে আসা টাকার অর্ধেকই মূলত তার পকেটেই যায়। অর্থাৎ তার পকেটে মাসে ঢুকে ৩০ লাখ টাকা। মানে দাঁড়াচ্ছে সুন্দর আলীর প্রতিদিনের আয়ই লাখ টাকা। প্রায় একই রকম আয় আবুল খান, শাহাব উদ্দিন, ইকবাল আহমদ, মামুনুর রশীদ ও আলতাফ আহমদের। সুন্দর আলীর মতো তারা প্রত্যেকেও একেকটি লাইনের নিয়ন্ত্রক। আবুল খানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে আম্বরখানা-সালুটিকর-কোম্পানীগঞ্জ লাইন। জকিগঞ্জ লাইনের খবরদারি রয়েছে শাহাবউদ্দিনের হাতে। মামুনুর রশীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মেডিকেল লাইন। আলতাফ আহমদ মুঠোয় পুরে রেখেছেন মৌলভীবাজার লাইন।
লাইনভিত্তিক আয়ের বাইরেও আয় রয়েছে অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন নেতাদের। যেমন মামুনুর রশীদ তার লাইনের বাইরে পুরো ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে তার আয়ের ক্ষেত্র হিসেবে কবজা করে নিয়েছিলেন। তাকে চাঁদা না দিয়ে কোনো অটোরিকশাই ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রবেশ করতে পারত না। এই কাঁচা টাকার বদৌলতে নগরীর কাজলশাহ এলাকায় উঠছে মামুনুর রশীদের আলিশান দালান। জানা গেছে, ওই দালানের কাজ এখনও শেষ না হলেও এরই মধ্যে এর পেছনে কোটি টাকার উপরে খরচ করেছেন মামুনুর রশীদ। তাজপুরে সুন্দর আলীর অনিন্দ্য সুন্দর যে দালান রয়েছে সেটি থেকেও চোখ ফেরানোর মতো নয়। টোকেন বাণিজ্যের মাধ্যমে দক্ষিণ সুরমার চ-িপুল এলাকায় আলতাফ আহমদ করেছেন সুবিশাল বাড়ি। তার রয়েছে প্রাইভেট গাড়িও।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সিলেট জেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নে আয়ের আরও খাত রয়েছে। এ ইউনিয়নে ১২৭টি উপশাখা। প্রতি তিন বছর অন্তর নির্বাচন হয় এসব উপশাখায়। সে হিসেবে গড়ে প্রতি বছর নির্বাচন হয় ৪০টি উপশাখায়। একেক নির্বাচন থেকে ইউনিয়নের আয় অন্তত ৫ লাখ টাকা। ক্যালকুলেটর টিপে দেখা গেছে, এ খাতে বছরে আয় ২ কোটি টাকা। অবশ্য সবাই এ টাকার ভাগ পান না। ইউনিয়নের সভাপতি জাকারিয়া আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক আজাদ মিয়ার পকেটেই মূলত যায় এ টাকা। আর সভাপতি হিসেবে এর বাইরেও জাকারিয়া আহমদের নিজস্ব আয়ের খাতও রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা উপশাখার আয়ের পুরোটাই যায় তার পকেটে। পাশাপাশি জেলার বৈধ প্রায় ২০ হাজার অটোরিকশার চাঁদা থেকে ৩ টাকা করে বরাদ্দ রয়েছে তার নামে। প্রতিদিন শ্রমিকের কষ্টের ৩ টাকায় জাকারিয়া আহমদের পকেটে জমে আরও ৬০ হাজার টাকা।
অভিযোগের বিপরীতে কী বলার আছে-জানতে মঙ্গলবার একাত্তরের কথার পক্ষ থেকে জাকারিয়া আহমদের মোবাইল ফোনে বার বার কল দেওয়া হয়। অপরপ্রান্তের স্বয়ংক্রিয় কণ্ঠ প্রতিবারই জানায়, ‘এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়’। তাইও আমাদের জানা হয়নি জাকারিয়া আহমদের বক্তব্য।
সিলেট জেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের গল্প তো শোনা হলো। একে একে আমরা শুনাবো পরিবহনের অন্য শ্রমিক ইউনিয়নের গল্পও, যারা কথায় কথায় ধর্মঘটের ডাক দিয়ে জিম্মি করেন সাধারণ মানুষকে।
সূত্র : একাত্তরের কথা