জৈন্তাপুর প্রতিদিন রিপোর্ট
সিলেটের সকল পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়ার দাবিতে মঙ্গলবার থেকে ৭২ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে বৃহত্তর সিলেট পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। তবে এ ধর্মঘটের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন সিলেট বাস মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ। তারা বলছেন ট্রাক শ্রমিকদের ধর্মঘটের সাথে বাস মালিক শ্রমিকদের কোন সম্পর্ক নেই।
এদিকে পাথর উত্তোলনের দাবীকে সামনে রেখে বিজয়ের মাসে বারবার পরিবহণ ধর্মঘটের ডাক দেয়া নিয়ে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্ন। একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ হাছিলের উদ্দেশ্যে পরিবহণ শ্রমিকদের লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পরিবহণ ধর্মঘটকে সফল করতে পাথর শ্রমিকদের মাঠে নামানো হবে বলে ও গুঞ্জন উঠেছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ধর্মঘটের ডাক দেয়ার জন্য পরিবহণ শ্রমিকদের কোটি টাকা দিয়েছেন পাথর ব্যবসায়ীরা। এসবের নেপথ্যে রয়েছেন জাফলংয়ের পাথর খেকো খ্যাত জামাই সুমন। নভেম্বর মাসে সিলেটে সাংবাদিকদের সাথে পরিবহণ শ্রমিকদের মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন জামাই সুমন। জামাই সুমনের উপস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন তুললে সেদিন সভাস্থল থেকে বের হয়ে যান জামাই সুমন। সেই সুমনই মূলত শ্রমিকদের আন্দোলনে নেপথ্যে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
মঙ্গলবার সকাল ৬ টা থেকে শুক্রবার সকাল ৬ টা পর্যন্ত পরিবহণ ধর্মঘটে সিলেট বিভাগে কোন ধরনের পরিবহণ চলবেনা বলে ঘোষণা দিয়েছেন সিলেট বিভাগ ট্রাক মালিক গ্রুপের সভাপতি গোলাম হাদী ছয়ফুল। সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে ছয়ফুল বলেন, পাথর কোয়ারী খুলে দেয়ার দাকিতে আমরা এতদিন শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছি। প্রধানমন্ত্রীকে ও স্বারকলিপি দিয়েছি। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। সর্বশেষ সোমবার বিকেলে আমরা সিলেটের জেলা প্রশাসকের সাথে বৈঠক করেছি। কিন্তু সেখানে থকে ও আশানুরুপ কোন কিছু আমরা পাইনি। যেকারনে বাধ্য হয়ে এ ধর্মঘট। তিনি দাবী করেন পরিবহণ সেক্টরের সকল শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা তিনদিনের ধর্মঘট আহ্বান করেছেন। অনুমতি পেলে ম্যানুয়েল পদ্ধতিতেই পাথর উত্তোলন করা হবে জানিয়ে গোলাম হাদী ছয়ফুল বলেন, পাথর ব্যবসায়ীদের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। তারা কথা দিয়েছেন সরকার অনুমতি দিলে ম্যানুয়েল পদ্ধতিতেই তারা পাথর তুলবেন। আর কোনো যন্ত্রের ব্যবহার করবেন না। পরিবেশও ধ্বংস করবেন না। আমরাও বিষয়টি তদারকি করবো। তবে এ ব্যাপারে সিলেট জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, বিজয়ের মাসে কোন ধর্মঘটের পক্ষে আমরা নই। আমরা তাদেরকে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলাম। কিন্তু তারা তা মানেননি। এখন ধর্মঘটে যদি শ্রমিকরা গাড়ি না চালায় তখন আমাদের কিছু করার নেই। এটা সম্পূর্ণ শ্রমিকদের বিষয়। তবে ধর্মঘটের পক্ষ আমরা নই।
জানা গেছে, প্রায় এক বছর ধরে সিলেটের চারটি পাথর কোয়ারি বন্ধ রয়েছে। পরিবেশ ধ্বংসরোধে এ সিদ্ধান্ত নেয় স্থানীয় প্রশাসন। উচ্চ আদালত থেকেও এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এমন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পাথর উত্তোলনের দাবি জানিয়ে আসছেন পাথর ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা।
সম্প্রতি এই দাবিতে মাঠে নেমেছেন পরিবহন ব্যবসায়ীরা। পাথর উত্তোলনের জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। সরকারকে নিজেদের দাবি মানাতে বাধ্য করতে বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছেন পরিবহন সমিতির নেতারা। সে লক্ষ্যে সিলেটে তিনদিনের পরিবহন ধর্মঘট ডেকেছেন তারা। যদিও পরিবেশকর্মীরা বলছেন, আবার পাথর উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া হলে পাথরখেকোরাই আশকারা পাবে। অনুমতি পেলে তারা পরিবেশ ধ্বংস করে পাথর উত্তোলনে উদ্যোগী হবে।
পরিবহন মালিকদের এই আন্দোলন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, পাথর উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও পাথর আমদানি তো নিষেধাজ্ঞা নেই। তাছাড়া যখন নিষেধাজ্ঞা ছিলো না তখনও সিলেটের কোয়রিগুলো থেকে সামান্য পরিমাণ পাথরই উত্তোলন হতো। বেশিরভাগই ভারত থেকে আমদানি করা হতো। আমদানি যেহেতু অব্যাহত রয়েছে তাই পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিম বলেন, আমার মনে হয় পরিবহন মালিক সংগঠনের নেতাদের পাথরখেকো চক্রই মাঠে নামিয়েছে। এই গোষ্ঠির ইন্ধনেই কাজ করছেন তারা। তিনি বলেন, অনুমতি পেলে পাথরখেকো গোষ্ঠি ম্যানুয়েলি পাথর তুলবে না। অনুমতি পেলেই তারা বোমা মেশিন দিয়ে পাথর তোলা শুরু করবে। এখন নিষেধাজ্ঞা থাকা অবস্থায়ও অনেক জায়গায় বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন করার অভিযোগ রয়েছে। তাই কোনো অবস্থায়ই আর পাথর উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া যাবে না।
পরিবেশকর্শী কাশমির রেজা বলেন, বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনের ফলে ভোলাগঞ্জ, শাহ আরেফিন টিলা, জাফলং, লোভছড়াসহ সবগুলো কোয়ারির পরিবেশ ধ্বংস করে ফেলার অভিযোগ রয়েছে পাথর ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। কেবল পরিবেশ ধ্বংস নয়, ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাথর উত্তোলনের ফলে মারা গেছেন অনেক শ্রমিকও।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)-এর হিসেবে, সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলো ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭৬ জন পাথর শ্রমিক নিহত এবং ২১ জন আহত হয়েছেন। তিনি বলেন, পাথর উত্তোলনে সরকারি নিষেধাজ্ঞার পর থেকেই উত্তোলনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন পাথর ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। এর সাথে যুক্ত হয়েছেন পরিবহন ব্যবসায়ীরাও। মূলত নিজেদের স্বার্থ হাছিলের উদ্দেশ্যে পরিবহণ শ্রমিকদের সুকৌশলে আন্দোলনে নামানো হয়েছে।