চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সোনা পাচারকারীদের তৎপরতা থামছে না। পাচারকারীরা নানা কায়দায় মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা চ্যানেল পেরিয়ে সোনার চালান তাদের গোপন গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। গত কয়েক বছরে ধরা পড়েছে অনেকগুলো চালান। তবে পাচারকারীদের চালানের কতটুকু ধরা পড়ছে, আর কতটুকুই বা পাচারকারীরা বিমানবন্দরের নিরাপত্তা চ্যানেল ফাঁকি দিয়ে বাইরে নিয়ে যেতে পারছে, সে ব্যাপারে নিরাপত্তা কর্মকর্তারাও নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না।
এদিকে মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে এই বিমানবন্দরে গত ২৩ মার্চ আবারও ধরা পড়ল পাচারকারীদের বাহকসহ প্রায় ৪ কেজি ওজনের সোনার একটি বড় চালান। এই চালানও এসেছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই থেকে বাংলাদেশ বিমানের একটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে। বিমানবন্দর গোয়েন্দা সূত্রগুলো ইত্তেফাককে জানিয়েছে, শুধু বাংলাদেশ বিমানই নয়, এয়ার এরাবিয়ার মতো বিদেশি অন্যান্য সংস্থার ফ্লাইটেও বিপুল পরিমাণ অবৈধ সোনা পাচার প্রক্রিয়ায় চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসছে। অনেক চালান ধরাও পড়ছে। তবে তাদের মতে, বাংলাদেশ বিমানে করে আসা সোনার চালানই বেশি বলে ধরা পড়া চালানগুলো বিশ্লেষণ করে বোঝা যাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবারের চালানটিও বাংলাদেশ বিমানের বিজি-১৪৮ নম্বরের ফ্লাইটে করে এসেছে।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক উইং কমান্ডার তাসনিম আহমেদ বলেন, গত ২৩ মার্চ দুবাই থেকে আসা এক যাত্রীর কাছ থেকে অবৈধভাবে আনা যে ৩২টি সোনার বার, স্বর্ণলংকারসহ প্রায় চার কেজি সোনা উদ্ধার করা হয়, সেগুলোর দাম প্রায় ৩ কোটি ২১ লাখ টাকা। উদ্ধারকৃত সোনার বারগুলোর মধ্যে ৯টি উদ্ধার করা হয়েছে যাত্রীর পেটের ভেতর থেকে। ঐ যাত্রী প্যান্ট, জুতা ও পায়ুপথে সোনার বারগুলো লুকিয়ে রেখে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে আসছেন গোপন সূত্রে এমন খবর আগে থেকেই পান কাস্টমস গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা। ঐ সোনা পাচারকারী যাত্রী মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিনের(২৫) বাড়ি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ধলই ইউনিয়নের এনায়েতপুর গ্রামে।
কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রামের যুগ্ম পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, ইমিগ্রেশন শেষ হওয়ার পর ঐ যাত্রীকে হেফাজতে নিয়ে তল্লাশি করে তার প্যান্টের ভেতর থেকে ১৫টি ও জুতার ভেতর থেকে ৮টি সেনার বার উদ্ধার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে জিয়া পেটের ভেতরে করে আরও সোনার বার আনার কথা জানালে তাকে এক্সরে করা হয়। এক্সরে রিপোর্ট দেখে নিশ্চিত হয়ে তার রেক্টামের মাধ্যমে আরও ৯টি সোনার বার উদ্ধার করা হয়। তার শরীরে আরও ৯৯ গ্রাম স্বর্ণালংকার পাওয়া গেছে। তার কাছ থেকে উদ্ধারকৃত সোনার মোট পরিমাণ ৩ কেজি ৮২৭ গ্রাম।
এর আগে এই বিমানবন্দরে গত ২৫ জানুয়ারি প্রায় পৌনে ২ কেজি সোনা নিয়ে চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশের সময় ধরা পড়েন মোহাম্মদ জিয়াউল হক নামের এক পাচারকারী। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) ও বিমানবন্দর শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ঐদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পাচারকারীর সোনা উদ্ধারে নগরীর হাজারি গলিতে স্বর্ণকারের শরণাপন্ন হন। কারণ দুবাই থেকে আসা পাচারকারী ব্যক্তি তার পাচারের সোনার মোট ১ কেজি ৪২৯ গ্রাম গলিয়ে গেঞ্জি ও অন্তর্বাসের মধ্যে প্রলেপ দিয়ে তা পরিধান করে এসেছিলেন। পাচারকারীর এই কৌশল গোয়েন্দা বর্মকর্তাদের কাছে ছিল অভিনব। এছাড়া ফ্লাই দুবাই এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে আসা যাত্রীটির কাছে আরও পাওয়া যায় ২৩৩ গ্রাম ওজনের দুটি সোনার বার এবং ১০০ গ্রাম ওজনের কিছু স্বর্ণালংকার। ধরা পড়া এসব সোনার আর্থিক মূল্য ধরা হয়েছিল ১ কোটি ২৭ লাখ ৮৪ হাজার ৯০ টাকা।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক উইং কমান্ডার তাসনিম আহমেদ জানান, যেসব ব্যক্তি সোনাসহ ধরা পড়ছে, তাদের অধিকাংশই ক্যারিয়ার। মূল পাচারকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে।
বিমানবন্দরের সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের ভেতরে বাংলাদেশ বিমানের গ্রাউন্ড সাপোর্ট ইকুইপমেন্ট অঞ্চলে বিমানের চাকা কেটে এর ভেতর থেকে সাড়ে ৩ কোটি টাকা মূল্যের ৪৫টি সোনার বার উদ্ধার করেছিলেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। একই বছরের ১ জুন আরব আমিরাতের শারজাহ থেকে এয়ার এরাবিয়ায় চড়ে আসা এক যাত্রীর কাছ থেকে গোয়েন্দারা উদ্ধার করেন ৩৪টি সোনার বার। একই বছরের ১৬ জুন গোয়েন্দারা আরব আমিরাতের শারজাহ থেকে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে আসা এক যাত্রীর কাছ থেকে উদ্ধার করেন ১ কেজি ২৪৪ গ্রাম অবৈধ সোনা এবং ৯ কেজি শিসা নামের মাদক।
একই বছরের ১২ নভেম্বর দুবাই থেকে আসা বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটের একটি যাত্রী আসনের নিচে তল্লাশি চালিয়ে শুল্ক গোয়েন্দারা উদ্ধার করেন ৬ কেজি ৫২৪ গ্রাম ওজনের ৫৬টি সোনার বার, যার মূল্য ছিল ৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এগুলোর কোনো দাবিদার মেলেনি বলেও কর্মকর্তারা জানান। এছাড়া ২০২১ সালের ৯অক্টোবর জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) সংস্থার কর্মকর্তারা চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এক কর্মচারীকে আটক করে তার কাছ থেকে ৮০টি সোনার বার উদ্ধার করেন। দেশে যার বাজারমূল্য ছিল ৫ কোটি টাকা।