///

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশু-নির্যাতন, বাংলাদেশের আইন ও আমাদের মা-বাবা

30 mins read

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশু-নির্যাতন, বাংলাদেশের আইন ও আমাদের মা-বাবা

শিশুরা প্রকৃতির মূল্যবান সম্পদ, তাই ভালোবাসা এবং সচেতনতার সাথে তাদের বেড়ে তোলা উচিত, নিষ্টুরতার সাথে নয়। নিষ্টুরতা তাদের শরীর ও মনের অপূরণীয় ক্ষতির সৃষ্টি করে।

মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, “আমরা যদি সত্যিই শান্তির পৃথিবী তৈরি করতে চাই এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাই, তাহলে শিশুদের দিয়েই শুরু করতে হবে কিন্তু আমাদের ভালোবাসা ও শান্তির সাথে অগ্রসর হতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত পুরো পৃথিবী শান্তিতে পূর্ণ না হয়।” শিশুদের সমঝোতা, শান্তি এবং ধৈর্য্যশীলতার উপর ভিত্তি করে একটি দায়িত্বশীল সমাজের জন্য গড়ে তুলতে হবে।

বাংলাদেশে শিশু আইন, ২০১৩ এর ৪ ধারা অনুযায়ী, ১৮ বছর পর্যন্ত শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশ, তাদের শিক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়া ও ভবিষ্যতে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠার ক্ষেত্রে বিশেষ অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ গত ১৩ জানুয়ারি, ২০১১ তারিখে জনস্বার্থে দায়ের করা একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্কুল এবং মাদ্রাসায় সবধরণের শারীরিক শাস্তি অসাংবিধানিক ও মানবাধিকার লংঘন ঘোষণা করে রায় প্রদান করেন। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর ‘শিক্ষার স্তর নির্বিশেষে, বিশেষ কয়েকটি পদক্ষেপ ‘অধ্যায়ে ১০ ধারায় বলা হয়েছে, “শিক্ষার কোন স্তরেই শিক্ষার্থীরা যেন কোনো ভাবেই শারীরিক ও মানসিক শাস্তির মুখোমুখি না হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে।”

শিশু আইন ২০১৩ এর ৭০ ধারা অনুসারে শিশুর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিসাধন করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

স্কুলে শারীরিক শাস্তি বলতে যেকোন ছাত্র-ছাত্রীকে যেকোন ধরনের দৈহিক আঘাত করলে বুঝাবে। যেমন- কোন ছাত্র ছাত্রীকে হাত পা বা কোনোকিছু দিয়ে আঘাত করা / বেত্রাঘাত করা, শিক্ষার্থীদের দিকে চক-ডাস্টার বা এজাতীয় কোন বস্তু ছুড়ে মারা, আছার দেয়া ও চিমটি কাটা, দাড় করিয়ে রাখা, কান ধরানো, আঙুলের ফাঁকে পেন্সিল রেখে চাপ দেয়া, চুল ধরে টানা বা চুল কেটে দেয়া, ওঠবস করানো, চেয়ার বা টেবিলের নিচে মাথা ঢুকানো, কামড় দেয়া, অভিবাবকের অনুমতি ব্যতীত ছাত্র ছাত্রীকে মাঠ, ক্লাস পরিষ্কার করতে বলা বা কোনো কাজ করতে বাধ্য করা। ছাত্রছাত্রীকে এমন কোনো কথা বলা বা ইঙ্গিত করা বা আচরণ করা যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তা মানসিক শাস্তি হিসেবে গণ্য হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন রহিত করা সংক্রান্ত নীতিমালায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হইলে কর্তৃপক্ষকে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। এ আইন ভঙ্গ কারিকে অনধিক দশ হাজার টাকা জরিমানা বা তিনমাসের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ বিচার করতে ব্যর্থ হইলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তার বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নিতে বলা হয়ছে।

তবে নীতিমালার এক দশকের বেশি অতিক্রান্ত হওয়ার পরও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কোন পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচর না হওয়া দুঃখজনক। ২০২০ সালে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিশু নির্যাতন সম্পর্কিত এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনের আওতায় করা জরিপ থেকে দেখা যায়, এক মাসে দেশে ১-১৪ বছরের ৮৯ শতাংশ শিশুকেই শৃঙ্খলার নামে নির্যাতন করা হয়েছে।

২০১৬ সালে ব্লাস্টের এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশের ৬৯শতাংশ অভিভাবক মনে করেন, নীয়মানুবর্তিতার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। ৫৫ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন শিশুদের সুপথে নিতে শাস্তি সহায়ক। ২৭ শতাংশ মনে করেন শাস্তি না দিলে শিশুরা বখে যায়।

আসলে মারধর করে কিছু অর্জন করা যায় না। শিশু মন কোমল মন। তারা স্নেহ ও সমঝোতার মাধ্যমে শিখবে। শারীরিক ও মানসিক শাস্তি তাদের মনে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তা অকল্পনীয়। ছোটবেলা এধরনের নির্যাতনের শিকার হওয়ার কারণে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। তাদের মধ্যে ভয় কাজ করে। তাদের মেধার বিকাশ ব্যহত হয়। একটি অসুস্থ জেনারেশন তৈরি হয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিশুর গায়ে হাত তোলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শুধু স্কুলে নয়, শিশুরা যাতে বাড়িতেও সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠে তার জন্য রয়েছে কড়া আইন। একজন শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা তার বাড়িতে নিরাপদ না হলে সে কি করে একজন ভালো মানুষ হবে?

সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধে থাকা এই অপরাধ প্রতিরোধে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার দরকার। সেজন্য গ্রামে ও শহরে অভিবাবকদের সচেতন করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কঠোর পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষকদের সচেতন করতে হবে। শিশু নির্যাতন রহিত করা সম্পর্কিত আইনের প্রয়োগ জোরদার করতে হবে। এধরনের অপরাধ প্রতিরোধ করতে হবে। অপরাধের শিকার ভিকটিমকে সাহসের সাথে আইনি উপায়ে অপরাধীর মোকাবিলা করতে হবে। শিশুরা যাতে নিজেরাই মানসম্মত সেবা খুঁজে নিতে পারে এবং সহিংসতার ঘটনা ঘটলে নিজেই অভিযোগ জানাতে পারে উৎসাহিত করেছে ইউনিসেফ। হেল্পলাইন ১০৯৮-এ ফোন করে তারা এসব সেবা নিতে পারে। নারী ও শিশুর সহায়তায় জাতীয় হেল্পলাইন সেন্টারের নম্বর ১০৯–এ কল করে সেবা নিতে পারবেন নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু।তাছাড়া দেশের জরুরি সেবা নম্বর ৯৯১ এ ফোন করেও তারা অভিযোগ জানাতে পারবেন।

লেখক : প্রণব দাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Latest from Blog

x
English version