/

সিলেটের লাল শাপলাবিলের সেরা হতে পারে কানাইঘাটের ’আন্দু বিল” বা ”আন্দু গাং”

34 mins read

জৈন্তাপুর প্রতিদিন ডেস্ক::

আন্দু মানে অপ্রয়োজনীয়, অনর্থক, অর্থহীন ইত্যাদি। সে অর্থে ’আন্দু বিল’ হচ্ছে এমন একটি বিল যার আদৌ কোন প্রয়োজন নেই কিংবা একটি অর্থহীন বিল। রসিক মানুষদের মধ্যে যারা এমন নাম দিয়েছেন তা যে মোটেও যথার্থ হয়নি। কারণ নামকরণের সাথে বাস্তবতার সাথে কোন মিল নেই। নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য আর জীব বৈচিত্রের সমৃদ্ধ প্রকৃতির অপরুপ সৃষ্টির নাম হচ্ছে ’আন্দু বিল’। মিঠাপানির অফুরন্ত উৎসের বিল। বিলেরপারের ৩ টি ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পানি আর মাছের চাহিদা পুরণ করছে বিলটি। সিলেটের পর্যটনে এটি যুক্ত হলে জৈন্তাপুরের ডিবি বিলকে হার মানাবে৷
কুয়াশা মোড়ানো শীতের সকালে পথের ক্লান্তি ভুলে সে ’আন্দু বিলে’ গেলে দেখতে পাবেন, বিস্তির্ণ এলাকা জুড়ে পানির উপর ’লাল শাপলার’ দৌরাত্ব। প্রকৃতি যেন নিজ হাতে সাজিয়ে তুলেছে কুমারী মেয়ের মতো লাজুক অথচ সতেজ-আকর্ষণীয় শাপলা গুলো দিয়ে৷ যেন অপেক্ষারত ব্যাকুল প্রেমিকার এক প্রতিচ্ছবি। আর এর সাথে সকালের সোনাঝরা মিষ্টি রোদ যেন শাপলা গুলোর রুপ-লাবণ্য কয়েক গুন বাড়িয়ে তুলেছে৷ বিশাল দৈঘের বড় বিল আর সেখানে শাপলার দৌরাত্ব অনেক বেশি। বিশাল বিলের স্থানে স্থানে একতাবদ্ধ শাপলা গুলো যেন নিজেদের দৌরাত্বকে মজবুত করেছে রেখেছে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পেতে। লালের পাশাপাশি এখানে সাদা শাপলারও কোন কমতি নেই আন্দু বিলটিতে৷
সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার ৩টি ইউনিয়ন জুড়ে বিস্তৃত আন্দু বিলটি প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি। প্রকৃতি তার অকৃপণ হাতে নিজের মতো সাজিয়েছে এ বিলটিকে। বিলটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৬ কিলোমিটার এবং গড় প্রস্থ প্রায় সাড়ে ৪০০ মিটার। কানাইঘাট উপজেলার লক্ষীপ্রসাদ ইউপি, দিঘীরপার পূর্ব ইউপি এবং সাতঁবাক ইউনিয়নের মধ্যস্থলে বিলটির অবস্থান।
যেভাবে যাবেন:
সিলেট শহর থেকে বিলটির দূরত্ব প্রায় ৫০কিলোমিটার। সিলেট-জকিগঞ্জ রোড হয়ে বাংলাবাজার নামক স্থানে নেমে জনপ্রতি ১০টাকা ভাড়ায় সিএনজি অটোরিকশা করে ভবানিগঞ্জ বাজার গেলে মিলবে আন্দুবিল। সে বাজার আন্দু বিলের তীরে অবস্থিত। এছাড়া সিলেট-জকিগঞ্জ রোড হয়ে সড়কের বাজার নেমে ১০টাকা ভাড়ায় লেগুনা বা সিএনজি অটোরিকশা ধরে লন্তির মাটি স্ট্যান্ডে গেলেই দেখা পাওয়া যাবে বিলটির। অপরদিকে সিলেট-তামাবিল সড়ক দিয়ে কানাইঘাট বাজার হয়েও বিলটিতে যাওয়া যায়। সময় সর্বোচ্চ এক ঘন্টা লাগতে পারে। বিল ভ্রমণের পাশাপাশি বাংলার আবহমান পল্লীর জীবনচিত্র দেখার এক অনন্য সুযোগ রয়েছে সেখানে৷

স্থানীয় ভাবে এটিকে আন্দুগাঙ্গ বা আন্দু বিল বা পুরাতন সুরমা গাং বলে ডাকা হয়। আবার অনেকে এটাকে ’আন্দু বরাক নদী’ নামে ডেকে থাকেন কারণ এক সময় সুরমাকে স্থানীয়রা বরাক নদী নামে অভিহিত করতো।

এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রবীণদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে এটাই ছিল সুরমার মূল প্রবাহপথ। এ অংশটি অনেকটা আকাঁবাকা। ১৮৯৭ সালের প্রলয়ংকারী ভূমিকম্পে সুরমা নদীর এ অংশের গতিপথ বদলে যায়। মূল প্রবাহ লক্ষ্মীপ্রসাদ ইউনিয়নের দিকে সৃষ্টি হয় এবং ক্রমে সেটিই সুরমার মূল প্রবাহপথে পরিণত হয়। নব সৃষ্ট সে প্রবাহ অনেকটা সোজা হওয়ায় নৌযোগাযোগের ক্ষেত্রে অনেক সুবিধার সৃষ্টি করে এবং এটাকে মূলপথ হিসেবে সরকার ব্যবহার শুরু করে। এ সময় থেকে আদি প্রবাহ অর্থাৎ বর্তমান আন্দুগাং একধরণের প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে। যার কারণে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার পুরাতন সুরমাকে স্থানীয় মানুষের কল্যাণের কাজে লাগানোর চিন্তা করে এবং এ অংশের দু’দিকে বাঁধ দিয়ে মূল সুরমা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এতে স্থানীয় মানুষের পানীয়-জলের অভাব দূর হওয়ার পাশাপাশি নদীভাঙ্গন সমস্যা থেকেও রক্ষা পায় ৩ ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমির নাম আন্দু বিল। প্রকৃতি তাঁর অকৃপণ হাতে রূপ-লাবণ্যের সবটুকু ঢেলে সাজিয়েছে এ বিলটিকে। লাল শাপলার পাশাপাশি এখানকার জীববৈচিত্র্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে। পর্যাপ্ত খাবার এবং মানুষের আনাগোণা কম হওয়ার কারণে এখানে পানকৌড়ি, বক, মাছরাঙ্গাসহ অনেক পাখির দেখা মেলে। দেশীয় মাছের এক নিরাপদ অভয়াশ্রম এ বিলে। বিলটির গভীরতাও অনেক বেশি। সারা বছর পর্যাপ্ত স্বচ্ছ পানি থাকা এবং না শুকানোর কারণে এখানে দেশীয় বিলুপ্ত প্রায় অনেক প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। জলজ অন্যান্য প্রাণিরও বিচরণ দেখা যায় এখানে। মোট কথা, জীববৈচিত্র্যের এক সমৃদ্ধ স্থানের নাম হচ্ছে ’আন্দু বিল বা আন্দু গাং’।

এছাড়া সিলেট-জকিগঞ্জ রোডের জুলাই নামক স্থান থেকে বিল পর্যন্ত স্বচ্ছ পানির একটি সুন্দর খাল রয়েছে। বিলের চার পাশে আছে ছোট ছোট অনেকগুলো গ্রাম। বিলের ধারে গড়ে উঠেছে দ্বীপের মতো ছোট ছোট দুটি চর। বিলের পাশ ঘেষে রয়েছে ৪টি জামে মসজিদ, ভবানীগঞ্জ বাজার ও জুলাই আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। রয়েছে ২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। বিলের পারের প্রায় প্রত্যেক বাড়ির সাথে পাকা বাঁধাই করা ঘাট। গোসল থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল কাজই এখানে সম্পাদন করেন স্থানীয় মানুষেরা।

দর্শনার্থীদের ভাষ্য মতে, লাল শাপলার অনেক বিল দেখেছি কিন্তু এত বিশালতার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিল কখনো দেখিনি। সত্যি অনেক সুন্দর, অনেক উপভোগ্য বিলটি।
এখানে আছে ছোট-বড় অনেক নৌকা আছে। যে কেউ নৌকা ভাড়া নিয়ে উপভোগ করতে পারেন এখানকার সৌন্দর্য্য। এখানকার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের চিত্র খুবই মনোহর। সময় থাকলে সেটাও উপভোগ করা যেতে পারে। বিলের ও গাংয়ের পাড়ের প্রাকৃতিক দৃশ্য সবাইকে মুগ্ধ করবে। বিলের বিশালতায় পর্যটকরা পাবেন অন্যরকম অনুভূতি। বর্তমানে প্রশাসন বিলটিকে জলমহাল হিসেবে ইজারা দিয়েছেন যাতে শাপলাসহ প্রাকৃতিক এ লেকের জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। ইজারা বাতিল করলে পর্যটকরা সচ্ছন্দ্যে বিল ভ্রমণ উপভোগ করতে পারবেন। পাশাপাশি স্থানীয় মানুষেরাও সারাবছর বিলটি হতে মাছ সংগ্রহ করতে পারবেন। প্রশাসন ও বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন জায়গাটিকে ’পর্যটন এলাকা’ ঘোষণা করে পর্যটকবান্ধব কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করলে ’আন্দু গাঙ্গ’ বা ’আন্দু বিল’ হতে পারে বিনোদনের এক চমৎকার স্থান। একইসাথে এটি স্থানীয় মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Latest from Blog

x
English version