////

ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সেতুবন্ধন খাসিদের “হকতই” : সজল স্বার্তী

53 mins read

উৎসব প্রাণশক্তির বিকাশ ঘটায়। দৈনন্দিন জীবনের সুখ, গ্লানি,যন্ত্রণা একঘেয়ে দিনযাপন থেকে মুক্তির জন্য মানুষ সন্ধান করে আনন্দ মুখরিত কিছু সুন্দর মুহূর্তের। নিজের আনন্দ সুখ সবার সাথে মিলিত হয়ে উপভোগের মঙ্গলময় ইচ্ছা থেকেই উৎসবের সৃষ্টি। অনেক উৎসব কালের পরিক্রমায় পরিবর্তন হয়। কিছু উৎসব সমৃদ্ধ হয় আবার কিছ উৎসব চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়। কোন কোন উৎসব আবার তার স্বকীয়তা হারিয়ে ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে। ক্ষয়িষ্ণু তালিকায় থাকা এমন একটি উৎসবের নাম “হকতই”।

জৈন্তায় বসবাসরত খাসিয়া বা খাসিদের বাৎসরিক প্রধান ধর্মীয় উৎসব “হকতই/HOKTOY”। উৎসবের সূচনা কখন, কোথায় এবং কিভাবে শুরু হয়েছিল তার সঠিক কোন ইতিহাস নেই। সম্ভবত প্রাচীন জৈন্তায় খাসি সভ্যতা বিকাশের সময় এই উৎসবের সূচনা। বাংলা মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তমী তিথিতে “হকতই” উদযাপিত হয়। এই উৎসবকে ঘিরে সমাজে নানান কাহিনী শোনা যায় তবে তার অনেকটাই লোককথা। জনশ্রুতি আছে যে, ‘তই’ নামে এক খাসি সেনতেং (খাসিদের একটি সম্প্রদায়) রমণী থেকে এই উৎসবের সূচনা হয়। তবে এর স্বপক্ষে নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য নেই। খাসি ভাষায় “হক” শব্দের অর্থ ‘অধিকার’বা ‘পাওনা’। “হক” থেকে “হকতই” শব্দের আগমন হয়ে থাকতে পারে। অনেকে আবার “হকতই”এর সাথে হিন্দুদের সপ্তই বা হপ্তয়ের সাদৃশ্য খুঁজে থাকেন। মাঘের সপ্তমীতে অসমীয় হিন্দুরা হপ্তই বা সপ্তই নামে পুজা করে থাকেন। অসমীয়রা “স” কে “হ” বলে উচ্চারণ করে। সপ্তমী থেকে হপ্তমী বা হপ্তই এবং হপ্তই থেকে “হকতই” শব্দটির উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে। তবে উৎসব পালনের উদ্দেশ্য ও রীতিনীতিতে এ দুয়ের মাঝে বেশ পার্থক্য রয়েছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, উৎসবের সময়টা কৃষি নির্ভর খাসিদের প্রধান ফসলগুলো উৎপাদনের মৌসুমে, যেমন সুপারী, কমলা, ধান ইত্যাদি। খাসিদের মাঝে নতুন ফসল খাওয়ার আগে উব্লাইকে (UBLAI/স্রষ্টা) এবং পূর্বপুরুষদের নিবেদন করে খাওয়ার রীতি প্রচলিত। এখনো অনেক বয়স্ক খাসি মহিলা আছেন যারা নতুন ধান, সুপারী, বরইয়ের মত ফল হকতইয়ের আগে খাওয়ার ক্ষেত্রে এক ধরনের অপরাধবোধে ভোগেন, খান না বা খেতে চান না। তারা মনে করেন, মৌসুমের নতুন ফসল স্রষ্টাকে নিবেদন করে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ দিয়ে তবেই খেতে হয়। এই প্রথা বংশ পরস্পরায় এখনো খাসি সমাজের একটা অংশ মেনে চলেন।

স্রষ্টার কাছে বিশেষ প্রার্থনা ও পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনের দিন হিসাবে মাঘ সপ্তমীতে হকতই পালন করা হয়। পূর্বপুরুষদের স্মরণে শ্রদ্ধার সাথে অর্ঘ্য (সিয়াংজা/SIANG-JA) নিবেদনের প্রচলিত এই রীতিই “হকতই”। হকতই ২ দিনে পালন করা হয়। প্রথম দিন অর্থাৎ হকতই’য়ের দিন ধর্মীয় বিষয়গুলি প্রাধান্য পায়। দ্বিতীয় দিনকে বাই-হকতই বলে, এই দিন আনন্দ-উল্লাসের মাধ্যমে শুরু হয়। পারস্পরিক নিমন্ত্রণ রক্ষাসহ সামাজিক নানান রেওয়াজের পালন ছাড়াও এ দিনে সাংস্কৃতিক বিষয়গুলিকে প্রাধান্য পেতে দেখা যায়। হকতই’য়ের দিনে পূর্বপুরুষদের স্মরণে তাদের আত্মার শান্তি কামনায় ঈশ্বরকে স্মরণপূর্বক তাদের উদ্দেশ্যে জল, নানান ধরনের ফল, পিঠাসহ রান্না করা ঐতিহ্যবাহী খাবার প্রস্তুত করে খাসি ধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী পূজার্চনা করা হয়। অতঃপর পূর্বসূরীদের আত্মার শান্তি কামনা এবং নিজেদের সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি এবং খাসি সমাজের মৌলিক ৩ নীতিকে জীবনে সঠিকভাবে পালনের অঙ্গীকার করে আর্শীবাদ প্রার্থনা করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, খাসি সমাজ ও সংস্কৃতির পুরো ব্যবস্থাটিই খাসি ধর্মের ৩ টি মৌলিক নীতি বা সূত্র থেকে উদ্ভূত সেগুলি হল: ক) “টিপ ব্লাই টিপ ব্রু (TIP BLAI TIP BRU)” ইশ্বরকে জানা, মানবকে জানা, নীতিজ্ঞান অর্জন করা, সৃষ্টির সেবা আর মানুষত্বকে সম্মান করা। খ) “টিপ কুর টিপ খা (TIP KUR TIP KHA)” কুলজ্ঞান অর্জন করা, কুলনীতি পালন করা এবং মাতৃ- ও পিতৃ পরিবার ও বংশের প্রতি কর্তব্যপরায়ন ও নিষ্ঠাবান হওয়া। গ) “কামাই ইয়াকা হক (KAMAI IAKA HOK)” সৎ উপার্জন করা ও সততার সাথে ন্যায়সঙ্গতভাবে জীবনযাপন করা । খাসিদের বিশ্বাস ইশ্বর প্রদত্ত এই ৩টি সূত্রের যথাযত পালনই মানব মুক্তি ও ইশ্বরের সান্নিধ্য লাভের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।

হকতইয়ের দিনে ধর্মীয় কার্যাদি “সিয়াংজা” সম্পন্ন করা জৈন্তার খাসি সেনতেংদের জন্য আবশ্যক পালনীয় কার্য। প্রস্তুতকৃত খাবার প্রথমে আলাদা করা হয় ধর্মীয় কাজের জন্য। প্রথমত কয়েকটি কলাপাতার অগ্রভাগ কেটে পরিস্কার করে ধুয়ে মুছে ধর্মীয় কার্যাদি সম্পাদনের জন্য নির্ধারিত স্থানে পূর্ব দিকে মুখ করে সাজিয়ে রাখা হয়। যাদের উদ্দেশ্যে নিবেদন কার্য করা হবে তাদের একেক জনের জন্য একটি অথবা অনেক জনের জন্য একটি কলাপাতায় উৎসর্গের উদ্দেশ্যে খাবার সাজিয়ে রাখা হয়। তারপর শুরু হয় নিবেদনের ধর্মীয় কার্যাদি। সাধারণত মাতুলালয়ের কর্তা (U-Kñi) ও বাড়ির বয়স্ক মহিলারা এ কার্যাদি করে থাকেন। তবে তাদের অনুপস্থিতিতে বাড়ির অন্য সদস্যরা এ কার্যাদি সম্পন্ন করে থাকেন। ধর্মীয় কাজ শেষে বাড়ির সবাই সমবেত হয়ে স্রষ্টার কাছে পূর্বসূরীদের আত্মার শান্তি কামনা এবং নিজেদের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করেন। উৎসর্গকৃত খাবারের কিছু অংশ বাদ দিয়ে বাকীটা প্রসাদস্বরূপ নিজ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এ প্রক্রিয়া হকতইয়ের দিন সূর্যাস্তের পূর্বে সম্পন্ন করা বাধ্যতামুলক। সূর্যাস্তের পর অবশিষ্ট থাকা খাবার মাটির গর্তে পূঁতে ফেলা হয়।

খাসিদের পালনীয় অশুচিকালীন সময়ে হকতই পালন করা থেকে সে পরিবারকে বা ক্ষেত্রবিশেষে সে পাড়াবাসীকে বিরত থাকতে হয়। যেমন কেউ মারা গেলে তার দেহ দাহের পর সমাধি দিয়ে মৃত্যুত্তোর কার্যাদি/অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন না করা পর্যন্ত এবং সন্তান প্রসবের পর ভুমিষ্ঠ সন্তানের নাম রাখার ধর্মীয় কার্যাদি (নহ্-মনসহ্) শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে পরিবারকে হকতইয়ের ধর্মীয় কার্যাদি থেকে বিরত থাকতে হয়। কারো বসন্ত বা হাম হলে, সে পরিবার ও পাড়াবাসীদেরও হকতইয়ের কার্যাদি থেকে বিরত থাকার বিধান রয়েছে।

জৈন্তার খাসিরা আজও নিজ ভাষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতির অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ হিসাবে হকতইকে লালন করে আসছে। খাসি রাজাদের রাজত্বকালে এ অঞ্চলে বৃহৎ পরিসরে হকতই উদযাপিত হত। বর্তমানে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট ইউনিয়নের খাসি ছাড়া অন্য এলাকার খাসিদের মধ্যে হকতই পালন করতে দেখা যায় না। সময়ের পটপরিবর্তনে মুল খাসি তথা খাসি ধর্ম যাকে ‘নিয়ম ছনং বা নিয়মট্রে’(NIAMTRE) বলা হয় তার পালনকারীদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় খাসিদের মধ্যে এই উৎসব উদযাপনে ভাটা পড়েছে। তবে হারিয়ে যেতে বসা হকতইকে ঘিরে জৈন্তার খাসিদের মধ্যে এখনো উৎসাহ-উদ্দীপনার কোন কমতি নেই। তাদের কাছে এটা খুবই পবিত্র একটি দিন। উৎসবের দিনগুলোতে কর্মব্যস্ত মানুষেরা ফিরে আসতে চায় নিজভূমিতে। হকতইয়ের সপ্তাহ-দশদিন পূর্ব থেকে দূর দুরান্তে অবস্থানরত আত্মীয় স্বজনরা নিজপাটে জড়ো হতে থাকে। সারা বছর জীবন ও জীবিকার তাগিদে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকলেও এই দিনে সবার চেষ্টা থাকে নিজ ভিটা-বাড়িতে উপস্থিত থাকার। বাড়ির সবাইকে নিয়ে হকতই করার মজাই আলাদা। হকতই এর দু-তিন দিন আগে থেকে পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যায় প্রতিটি বাড়িতে। পিঠা খাওয়ার জন্য এ দিনের তুলনা হয় না। ভোর হতে প্রতিটি বাড়ী যথাসাধ্য আগে আত্মীয় স্বজনদের বাড়ীতে পিঠা পাঠানোর চেষ্টা করে। পরিবারগুলির মধ্যে চলে পিঠা বিনিময়ের পারস্পরিক প্রতিযোগিতা। হকতই-এ দেশী-বিদেশি নানা রকম পিঠার মধ্যে শীতল পিঠাই উল্লেখযোগ্য। খাসিদের কাছে শীতল পিঠা খুব প্রিয়। বলা চলে শীতল পিঠাই খাসিদের জাতীয় পিঠা। ঢাকনাসহ মাটির তৈরি বিশেষ ধরনের তাওয়ায় চালের গুড়া দিয়ে এ পিঠা রান্না করা হয়। এটা মাছ ভাঁজি, সবজি ভাঁজি, মাংস কিংবা তরকারির সাথে খাওয়া হয়। হকতই-এর ধর্মীয় কার্যাদিতে শীতল পিঠা আবশ্যক। উৎসবে পরিবেশিত অন্য খাবারগুলির মধ্যে খাসিদের ঐতিহ্যবাহী রান্না জাদহ্, ঝুর নাই, ঝুর রসা, দহ্-জিয়াম, দহ-খেলেহ্, তপু-স্লা অন্যতম। মজাদার খাবার নতুন জামা-কাপড় ও কুশল বিনিময় হকতইয়ের প্রাণ। হকতই একদিনের হলেও আনন্দ উল্লাস থাকে অনেকদিন পর্যন্ত।

খাসিদের উৎসব হলেও অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বহু ধর্ম-বর্ণের সামাজিক সম্প্রীতির এই জনপদে হিন্দু-মুসলিম ও অন্যান্য আদিবাসীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে হকতই প্রাণবন্ত হয়। খাসি জাতির এই ধর্মীয় উৎসব যুগ যুগ ধরে জৈন্তাপুর এলাকার সংস্কৃতির একটি অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। খাসিদের মধ্যে উপমহাদেশের অন্য সংস্কৃতি বিশেষ করে বাংলা বা বাঙালি সংস্কৃতির প্রভাব সুস্পষ্ট। তবে তারা নিজ ভাষা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক রীতিনীতির প্রতি যথেষ্ঠ শ্রদ্ধাশীল। শিক্ষাদীক্ষায় শিক্ষিত হওয়ায় তারা আজ আপন স্বকীয়তার ব্যাপারে বিগত কয়েক প্রজন্মের চেয়ে অধিক সচেতন। তবে তরুণ-তরুণীদের মধ্যেই এ উৎসাহ সর্বাধিক পরিলক্ষিত হয়। নিজ সংস্কৃতির লালন ও চর্চায় খাসিদের সামাজিক সংগঠন “খাসিয়া সেবা সংঘ” বিগত কয়েক বছর থেকে “হকতই” উৎসবে নানা আয়োজনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। সংঘ আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে খাসি লোকগীতি, কৌতুক, কবিতা ও নৃত্যের পাশাপাশি সমসাময়িক আধুনিক বাংলা, হিন্দী গান ও নৃত্যও থাকে। এসব অনুষ্ঠানে যথাসাধ্য খাসি গান, কৌতুক, কবিতা ও নৃত্যের পরিবেশন নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির লালন, বিকাশ ও চর্চার ইচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ। সদিচ্ছা, সচেতনতা ও গঠনমূলক সঠিক পরিকল্পনা গ্রহন এবং তার বাস্তবায়নের মাধ্যমে জৈন্তার খাসিরা তাদের স্বর্ণালী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখুক। বাংলাদেশের বৈচিত্রময় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অনুষঙ্গ হিসাবে খাসিদের “হকতই” বেঁচে থাকুক অনন্তকাল।

লেখক: নিটল নিলয় গ্রুপে তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের প্রধান হিসাবে কর্মরত এবং খাসিয়া সেবা সংঘের সদস্য। email: sojolsarty@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Latest from Blog

x
English version