//

জাপার অবস্থানের বিপরীতে রওশন এরশাদ

39 mins read

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া-না-নেওয়া এবং নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার প্রশ্নে কোনো অস্পষ্টতা না রেখে সরাসরি দলীয় অবস্থানের বিপরীতে দাঁড়ালেন ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। এক ভিডিও বার্তায় রওশন ঘোষণা দিলেন, ‘জাপা নির্বাচনে অংশ নেবে।’ ইভিএম প্রশ্নেও তিনি সরাসরি ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘অবশ্যই আমরা ইভিএমের মাধ্যমেই নির্বাচন করব। আমি জানি, নির্বাচন যা হবে, ভালোই হবে।’

বৃহস্পতিবার রাজধানীর পুরানা পল্টনের একটি হোটেলে ‘জাতীয় পার্টির’ ব্যানারে রওশনের কিছু অনুসারীর আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তার ধারণকৃত ভিডিও বার্তাটি প্রচার করা হয়। ভিডিও বার্তাটি ধারণ করা হয়েছে গত মাসের শেষ দিকে।
আগামী ২৬ নভেম্বর দলের যে দশম কাউন্সিল ডেকেছেন, রওশন সেটি সম্পর্কেও প্রথম বারের মতো সরাসরি কথা বললেন। ভিডিও বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘কাউন্সিল ডেকেছি, এর অনেক কারণ আছে। বিশেষ করে, গত কাউন্সিলে আমাদের গঠনতন্ত্রকে পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে। যেখানে যেখানে যার যার ক্ষমতা ছিল, সে ক্ষমতা খর্ব করে দেওয়া হয়েছে। অনেক জায়গায় সংশোধন করে নতুন করে গঠনতন্ত্র আনা হয়েছে। এটা ঠিক হয়নি। পার্টিকে শক্তিশালী করতে হবে।’

রওশন দলের যে কাউন্সিল ডেকেছেন সে সম্পর্কে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের ইতিমধ্যে ইত্তেফাককে বলেছেন, ‘জাপার কাউন্সিলের এখনো সময় হয়নি, বর্তমান কমিটির মেয়াদও রয়েছে আরো অনেক দিন। তাছাড়া, দলের কাউন্সিল ডাকার কোনো গঠনতান্ত্রিক এক্তিয়ার তার (রওশনের) নেই। এটা সম্পূর্ণ এক্তিয়ারবহির্ভূত ও বিভ্রান্তিকর। এর সঙ্গে জাপার কারও কোনো সম্পর্ক নেই।’

ভিডিও বার্তায় কাউন্সিল নিয়ে রওশনের বক্তব্য সম্পর্কে জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘আমি পার্টির মহাসচিব, কে কোথায় কিসের কাউন্সিল ডেকেছে আমরা কেউ কিছুই জানি না। আমাদের দলের সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে যারা রয়েছেন তারাও কিছু জানেন না। দলের চেয়ারম্যান, প্রেসিডিয়াম, এমপিরা কেউ কিছু জানেন না। তাছাড়া, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিল ডাকার তো ওনার (রওশনের) কোনো এক্তিয়ারই নেই। কাউন্সিল ডাকতে হলে তো আমি পার্টির মহাসচিব, আমার জানার কথা।’

গতকাল নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপরিউক্ত বক্তব্য ছাড়াও চুন্নু আরো বলেন, ‘জাপা এখন আর কারো দালালি করে না। জাপার নিজস্ব যেই রাজনীতি, আমরা সেটা নিয়েই সামনে এগিয়ে যাচ্ছি।’

জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ইতিমধ্যেই দলীয় অবস্থান ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘জাপা ইভিএমের পক্ষে নয়। ইভিএম কারচুপির মেশিন।’ তবে দলের এই অবস্থানে বিপরীতে গিয়ে রওশন তার ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ‘ইভিএমেই নির্বাচন করব। সারা বিশ্বে এখন ইভিএম চলছে। ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন হচ্ছে। কাজেই আমার দেশে ইভিএম করতে এটা তো নতুন কিছু নয়। যখন আমরা ৫-জি ব্যবহার করছি, তখন ইভিএম ব্যবহারে বাধা কোথায়? যারা নির্বাচনে জিতে যায়, তারা বলে নির্বাচন ফেয়ার হয়েছে। আর যারা হেরে যায়, তারা বলে নির্বাচন ফেয়ার হয়নি, ইভিএমের মাধ্যমে কারচুপি হয়েছে। অবশ্যই ইভিএমের মাধ্যমেই নির্বাচন করব।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়ার প্রশ্নেও দলের শীর্ষ নেতৃত্বের অবস্থানের সঙ্গে রওশনের বক্তব্যের বৈপরীত্য দেখা দিয়েছে। জি এম কাদের বলেছেন, ‘নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্ত কঠিন। আমরা সার্বিক পরিস্থিতি অবলোকন করছি। সামনে অনেক উত্থান-পতন ঘটবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলের সবার সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

কিন্তু রওশন তার ভিডিও বার্তায় রাখঢাক না করে সরাসরিই বললেন, ‘জাপা কখনো নির্বাচন বর্জন করেনি। জাপা সবসময় নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। দুর্দিনেও আমরা নির্বাচন করেছি, ১৯৯০ সনে। তখনও জাপা নির্বাচন বর্জন করেনি। জাপা সবসময় নির্বাচনে বিশ্বাস করে এবং নির্বাচনে অংশ নেয়। আগামী নির্বাচনেও জাপা অংশ নেবে ইনশাআল্লাহ।’

রওশন এরশাদ বলেন, ‘দলের নেতাকর্মীরা দুর্দিনেও আমাদের পাশে ছিল, এখনো পাশে আছে। তারা পার্টিকে শক্তিশালী করে আগামী নির্বাচনে একটা ভালো ফলাফল হয়, এই লক্ষ্যেই তারা কাজ করবে, এটা আমার বিশ্বাস। দেশবাসীর উদ্দেশে বলব, তারা অনেক শারদীয় মানুষ। তারা সত্যের পক্ষে থাকে, ন্যায়ের পক্ষে থাকে। কাজেই আমি জানি নির্বাচন যা হবে, ভালোই হবে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা কাজ করবে, যারা নির্বাচনে জিতে আসবে। দেশবাসী নিশ্চয়ই ভালো থাকবে। দেশবাসী সবসময় আমাদের পাশে থেকেছে, আমাদের পছন্দ করেছে। সবসময় আমাদের ভোট দিয়ে জয়ী করেছে। আমি মনে করি, এবারও তারা ভালো থাকবে, নির্বাচনে ভালো ফলাফলই হবে এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ করবে।’

সংবাদ সম্মেলনে রওশনের পক্ষে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন তার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ। তার লিখিত বক্তব্য পাঠের পর রওশনের ভিডিও বার্তাটি সাংবাদিকদের সামনে প্রচার করা হয়।

ধারণকৃত এই ভিডিও বার্তায় রওশন বলেন, ‘আমার স্বাস্থ্য বেশ ভালো। আল্লাহর রহমতে আমি এখন বেশ ভালো আছি। আমি এখন অনেকটা সুস্থ। পায়ের গিরায় সমস্যা আছে। সেটার জন্য এখানে আমি ফিজিওথেরাপি নিচ্ছি। হার্ট, কিডনি সব ভালো আছে। আমার ক্যানসার নেই। আগামী মাসেই (চলতি অক্টোবরে) দেশে ফিরে আসব।’

জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক আরো বলেন, ‘এইচ এম এরশাদের মৃত্যুর পরে পার্টি অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে, হেলে পড়েছে। মনে হয় পার্টিটা ঠিকমতো পরিচালিত হচ্ছে না। পার্টিটাকে সঠিকভাবে দাঁড় করাতে হবে। শক্তভাবে দাঁড় করাতে হবে। আমি এখানে (ব্যাংককের হাসপাতালে) আছি ১১ মাস হচ্ছে। কিন্তু, আমার প্রতিদিন নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। অনেক কিছুই জানছি। আগামী নির্বাচনের জন্য অবশ্যই আমি নেতাকর্মীদের কাছ থেকে ম্যান্ডেট নিচ্ছি। যারা পার্টির পতাকাতলে আসার জন্য ব্যস্ত, যারা পার্টি থেকে বহিষ্কার হয়ে গেছেন, পার্টিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন, তারা এখন সক্রিয় হতে চাচ্ছেন। আবার পার্টি করার জন্য তারা উদগ্রীব। আবার সবাই মিলে যদি সক্রিয় হই, জাপাকে নিশ্চয় একটা ভালো জায়গায় নিয়ে যেতে পারব।’

বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘রওশন এরশাদের অভিভাবকত্বে নতুন-পুরাতন, অবহেলিত, অব্যাহতিপ্রাপ্ত, বহিষ্কৃত, নিষ্ক্রিয় ও অন্য দলে চলে যাওয়া সব নেতাকর্মীকে এক মঞ্চে একত্রিত করে জাপাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাউন্সিল ডাকা হয়েছে।’

উল্লেখ্য, রওশনের ডাকা কাউন্সিল প্রস্তুতি কমিটির সদস্যসচিব গোলাম মসীহ বর্তমানে জাপার প্রাথমিক সদস্যও নন। সংবাদ সম্মেলনে জাপার প্রবীণ নেতা অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান, দলটির এক সময়ের প্রেসিডিয়াম সদস্য এস এম এম আলম, সম্প্রতি বহিষ্কৃত জিয়াউল হক মৃধা, কাজী মামুনুর রশিদ, এম এ গোফরান, সাবেক এমপি জাফর ইকবাল সিদ্দিকী, নুরুল ইসলাম, ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ও অধ্যাপক ইকবাল হোসেন রাজু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Latest from Blog

x
English version